সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ গিয়ে আর দেশে না ফেরা প্রবণতা বন্ধ করতে সরকারি
পাসপোর্ট ব্যবহার করে ব্যক্তিগত কাজে বিদেশ ভ্রমণে কড়াকড়ি করতে যাচ্ছে
সরকার। এজন্য অফিশিয়াল পাসপোর্ট দেওয়ার নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
সরকারি কাজে যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বিদেশে যাবেন, কেবল তাঁদেরই
অফিশিয়াল পাসপোর্ট দেওয়ার নিয়ম করা হচ্ছে। এই পাসপোর্ট নিতে হবে তাঁদের
বিদেশ ভ্রমণের জন্য দেওয়া সরকারি আদেশ (জিও) দেখিয়ে। এই জিও জারি করবে কেবল
মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
এ জন্য অফিশিয়াল পাসপোর্টের প্রাধিকার
পুনর্নির্ধারণ করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলেছে, অফিশিয়াল
পাসপোর্টের অপব্যবহার, এই পাসপোর্টে বিদেশ গিয়ে ফিরে না আসা এবং সরকারি
কর্মকর্তা-কর্মচারী সাজিয়ে মানব পাচার রোধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ
ব্যবস্থার ফলে অফিশিয়াল পাসপোর্ট পাওয়ার সুযোগ সংকুচিত হয়ে যাবে।
স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলেছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা সব মিলে
প্রায় ১৩ লাখ। বর্তমানে সরকারি দপ্তরের পিয়ন থেকে শুরু করে অতিরিক্ত সচিব
পর্যন্ত কর্মকর্তারা অফিশিয়াল পাসপোর্ট পেয়ে থাকেন। সচিবেরা ব্যবহার করেন
কূটনৈতিক পাসপোর্ট। ২০১১ সাল থেকে অফিশিয়াল পাসপোর্টের প্রাধিকারের গণ্ডি
বাড়ানো হয়। অফিশিয়াল পাসপোর্টে প্রতিবছর প্রায় দেড় লাখ সরকারি
কর্মকর্তা-কর্মচারী বিদেশে যান। এই পাসপোর্টে বিদেশ যাওয়া সহজ। কিন্তু
বিদেশে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ দেশে ফেরেন না। বর্তমানে
অফিশিয়াল পাসপোর্টের ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে সরকারি
চাকরিতে নেই এমন ব্যক্তিরাও অফিশিয়াল পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন। এতে
বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা সাজিয়ে “অফিশিয়াল
পাসপোর্টে” বিভিন্ন দেশে মানব পাচারের ঘটনার পর আমরা এ পর্যন্ত কয়েক হাজার
পাসপোর্ট বাতিল করেছি। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি দেশ থেকে অফিশিয়াল পাসপোর্ট
কমানোর অনুরোধ এসেছে। এ কারণে আমরা অফিশিয়াল পাসপোর্টের শ্রেণি
পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন থেকে গণহারে নয়, জিওর ভিত্তিতে অফিশিয়াল
পাসপোর্ট দেওয়া হবে।’
মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলেছে, পরিবর্তিত নীতিমালায়
সাধারণ পাসপোর্টকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হবে। সাধারণ জনগণকে সবুজ রঙের যে
পাসপোর্ট দেওয়া হয়, তেমন পাসপোর্টই দেওয়া হবে প্রথম শ্রেণির নিচের
কর্মকর্তাদের। তবে তাঁদের পাসপোর্টে লেখা থাকবে পিজি (পাসপোর্ট
গভর্নমেন্ট)। আর অফিশিয়াল পাসপোর্টের নম্বরের আগে লেখা থাকবে ওসি
(অফিশিয়াল ক্যাটাগরি)। বর্তমানে অফিশিয়াল পাসপোর্টধারীরা কেবল জিও নিয়ে
বিদেশ যেতে পারেন। কিন্তু নতুন নিয়মে তাঁদের আগে জিও নিতে হবে এবং সেই জিও
দেখিয়ে অফিশিয়াল পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে।
বর্তমানে সচিব থেকে
তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তা, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা কূটনৈতিক
পাসপোর্ট বা লাল রঙের পাসপোর্ট পান। অফিশিয়াল পাসপোর্টের রং নীল। এ ছাড়া
অন্যান্য সাধারণ পাসপোর্টের রং সবুজ। প্রাধিকার পুনর্নির্ধারণ করা হলে
সরকারি কর্মকর্তাদের দুই ধরনের পাসপোর্ট থাকবে। যাঁরা অফিশিয়াল পাসপোর্টের
জন্য প্রাধিকার পাবেন তাঁরা সরকারি সফরের ক্ষেত্রে নীল রঙের অফিশিয়াল
পাসপোর্ট ব্যবহার করবেন। এর বাইরে প্রাধিকার/নন-প্রাধিকার নির্বিশেষে অন্য
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবুজ রঙের পাসপোর্ট ব্যবহার করবেন। সরকারি
কাজে বিদেশ ভ্রমণের জিও পেলে তাঁরা অফিশিয়াল পাসপোর্ট পাওয়ার যোগ্য হবেন।
মন্ত্রণালয়ের
কর্মকর্তাদের মতে, অফিশিয়াল পাসপোর্ট নিয়ে জালিয়াতি বন্ধ করতে হলে
ভালোভাবে যাচাই করতে হবে। জিও ও এনওসি (অনাপত্তি সনদ) অফিসের ওয়েবসাইটে
প্রকাশ করা হলে জালিয়াতির মাধ্যমে অফিশিয়াল পাসপোর্ট দেওয়া বন্ধ হবে।
অফিশিয়াল
পাসপোর্টধারীদের বাংলাদেশের সঙ্গে ‘অন অ্যারাইভাল ভিসা’ চুক্তি থাকা
দেশগুলোতে ভিসা নিয়ে যেতে হয় না। ওই দেশে যাওয়ার পর ভিসা নিতে হয়।
বর্তমানে সিঙ্গাপুর, চীন, তুরস্কসহ ১৩টি দেশের সঙ্গে এই চুক্তি রয়েছে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার সঙ্গে এ চুক্তি হলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি। এই
চুক্তির সুবিধা নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী সাজিয়ে মানব পাচারের ঘটনা ঘটেছে।
স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযোগ রয়েছে, অফিশিয়াল পাসপোর্ট নিয়ে
সবচেয়ে বেশি বিদেশে চলে যাচ্ছেন বিসিএস চিকিৎসকেরা। প্রথমে সিঙ্গাপুরে গিয়ে
এমন পাসপোর্টধারীদের বেশির ভাগ অন্য দেশে চলে যাচ্ছেন, আর দেশে ফিরছেন
না। অফিশিয়াল পাসপোর্টে তুরস্কে গিয়েও অন্য দেশে চলে যাওয়ার অভিযোগ
রয়েছে। তুরস্ক থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর
পেরিয়ে ইতালি, স্পেনে যাওয়া যায়। সরকারি কর্মকর্তা সাজিয়ে অফিশিয়াল
পাসপোর্টে এসব পথে মানব পাচার হয়েছে। সম্প্রতি তুরস্ক সরকারের দেওয়া
চিঠিতে কয়েকটি মানব পাচারের ঘটনা প্রকাশ পায়। এরপরই অফিশিয়াল পাসপোর্ট
দেওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন,
উন্নত দেশগুলোতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়া কাউকে অফিশিয়াল পাসপোর্ট দেওয়া
হয় না। অফিশিয়াল পাসপোর্টের বিপরীতে দ্রুত ভিসা পাওয়া থেকে শুরু করে
বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় বলে সেখানে এই ব্যবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশে
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গড়ে সবাই অফিশিয়াল পাসপোর্ট পেয়ে থাকেন। এ
কারণে উন্নত কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের অফিশিয়াল পাসপোর্টের বিষয়ে আপত্তি
জানাচ্ছে।